সাতক্ষীরার আম দেশ পেরিয়ে বিদেশে
সাতক্ষীরা : আম পাকার মৌসুম সবে শুরু। আর শুরুতেই প্রতিদিন সকালে সাতক্ষীরা সুলতানপুর বড়বাজারে হাজার হাজার মণ আম বোঝাই নসিমন করিমন বাজারের সমস্ত রাস্তা দখল করে রাখে। দেখলে মনে হবে আমের মিছিল চলছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে যাচ্ছে এক রাস্তা থেকে অন্য রাস্তায় যেতে। জেলাজুড়ে গাছে গাছে এখন সুস্বাদু বাহারি জাতের আমের সমাহার।
বিষ ও কীটনাশকমুক্ত এমনকী ফরমালিনমুক্ত আম জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের ভেতর খ্যাতি ছড়িয়ে অন্য বছরের মত এবারও যাচ্ছে যুক্তরাজ্য, ইটালিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। শুরুতে বাজারে দেখা মিলছে হিমসাগর, গোপালভোগ, গোবিন্দভোগ-এই তিন জাতের আম। হিমসাগরের পাইকারি বাজার দর ২১শ' থেকে ২২শ' টাকা। গোপালভোগ ২২শ' থেকে ২৩শ' টাকা। গোবিন্দভোগ প্রায় ২৫শ' টাকা।
সাতক্ষীরার মানুষ বহুকাল ধরেই আম চাষে জড়িত। এ জেলায় আম এখন প্রধান অর্থকরী ফসল হিসেবে পরিণত হয়েছে। এ খাতে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। গাছের পরিচর্যা থেকে আম কেনাবেচা পর্যন্ত লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়ে থাকে এ অঞ্চলে। এদিকে, গাছে গাছে আমের সমারোহে আমবাগান হাতবদল হতে শুরু করেছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এরই মধ্যে সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলায় বাগান কিনেছে।
কৃষি বিভাগের পরামর্শ অনুযায়ী পোকাদমনে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করে সাতক্ষীরার চাষিরা ফলিয়েছেন বিষমুক্ত আম। আমের বাম্পার ফলনের আশা করেছিলেন আমবাগান মালিকরা। কিন্তু শুরুতেই ঝড়, বৃষ্টি এবং শিলা বৃষ্টির কারণে এবার আমের ফলন প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। মৌ মৌ গন্ধে সোনালি-হলুদের মিশ্রণে অপরূপে সাজে আম পাকতে শুরু করেছে। চিংড়ির পাশাপাশি হিমসাগর ও ন্যাংড়া আমের রাজধানী বলা হয় সাতক্ষীরা জেলাকে। পারিবারিকভাবে ছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে জেলাব্যাপী আমের চাষ হয়েছে এবারও। সাতক্ষীরা সদর, তালা, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও কলারোয়ায় আমের চাষ বেশি।
সার্বিক বিষয়ে তদারকি করে জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, জেলায় এবার তিন হাজার ৭১০ হেক্টর জমিতে (প্রতি হেক্টরে সাড়ে ১৩ মেট্রিক টন হিসেবে) উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন। তবে ফুল এবং মুকুল আসার সময় প্রচুর বৃষ্টি তার সঙ্গে শিলা বৃষ্টির কারণে আমের ফলন অর্ধেকে নেমে এসেছে।
সাতক্ষীরার মিষ্টি ও সুগন্ধযুক্ত বাহারি আম হিমসাগর, গোপালভোগ, ল্যাংড়া, গোবিন্দভোগ, কিষাণভোগ, গোলাপখাস, শরিফখাস, রানীপছন্দ, লতা, বোম্বাই, আম্রপালি, মল্লিকা, কালাপাহাড়, রুপালি ও কাঁচামিঠা আমের কোনোটিরই কদর কম নয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
চাহিদা থাকায় শুধু সাতক্ষীরার সুলতানপুর বাজার থেকেই প্রতিদিন দশ থেকে ১৫ ট্রাক আম যাচ্ছে দেশের সে সব অঞ্চলে।
কয়েক দিন আগে সদরের সীমান্ত এলাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা পাঁচ হাজার ৭০ কেজি আমে ফরমালিন মিশ্রণ করার সময় হাতে নাতে ধরে সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করেন। এরপর জেলা প্রশাসক আবুল কাসেম মো. মহিউদ্দিন আম প্রক্রিয়াকরণে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহারে বিক্রেতা, আমদানিকারক ও ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সতর্ক বার্তা দিয়েছেন। সাতক্ষীরার যেসব আমচাষি কোনো প্রকার স্প্রে ছাড়াই বিষমুক্ত আমের বাগান করেছেন, সে সব আমের গুণগত মানও ভালো।
গতবার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ থেকে আম রফতানির ব্যাপারে বিশ্বের শীর্ষ পণ্য ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল প্রকিউরমেন্ট লজিস্টিকসের সঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, হার্টেজ ফাউন্ডেশন ও এফএওর একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বাংলাদেশ হার্টেজ ফাউন্ডেশনের কারিগরি সহায়তায় ওয়ালমার্ট সাতক্ষীরার চাষিদের কাছ থেকে বাজারমূল্যের বেশি দাম দিয়ে আম কিনে নেয়। সেই থেকে অধিক দামের নিশ্চয়তা পাওয়ায় জেলার চাষিরা এখন রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার বন্ধ করে দিয়ে পোকা দমনে সেক্স ফেরোমন ট্র্যাপ ব্যবহার করে আমচাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
এ বছর সদর উপজেলার লাবসা এবং কুকরালীর একশ' চাষিকে আমচাষে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। তাদের উৎপাদিত আমই কিনে নেবে ওই প্রতিষ্ঠান।
Comments
- No comments found
Leave your comments