গবেষণা ছাড়াই আমে ব্যাগিং নিয়ে মতভেদ
কোনো প্রকার গবেষণা ছাড়াই আমের ব্যাগিং প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হওয়ায় দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিয়েছে।যেকোনো প্রযুক্তির আবিস্কার বা বিদেশ থেকে নিয়ে আসার পর বাণিজ্যিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩ থেকে ৫ বছরের গবেষণা চালানোর নিয়ম। এরপর তা কৃষক পর্যায়ে যাবে কীনা সে সিদ্ধান্ত আসে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকে। কিন্তু আমের ব্যাগিং প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহারে নেই কোনো গবেষণা, নেই কোনো নীতিনির্ধারণী ফোরামের সিদ্ধান্ত। এমনটাই জানিয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের(বারি) আম গবেষণা কেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জমির উদ্দিন।
তিনি বলেন, কোনো ধরণের গবেষণা ছাড়াই ২০১৪ সালে একজন বিজ্ঞানী বাজারে একটি ব্যাগ নিয়ে আসে। কিন্তু ২০১৫ সালের গবেষণা রিভিউতে এবিষয়টি নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে, বারি সদরদফতর থেকে গবেষণা করার নির্দেশনা দেওয়া হয় ঐ বিজ্ঞানীকে। তবে তিনি গবেষণা শুরু করলেও ফলাফল পাওয়ার আগেই ব্যাগিং বাণিজ্যও চালিয়ে যাচ্ছেন। যেটা গবেষণার মূলনীতি বিরোধী।
আমের ব্যাগিং প্রচলন মূলত: শুরু হয় চীনে। সেখানে এক ধরনের ব্যাগ দিয়ে আমকে ঢেকে রাখা হয়। যা বাইরের আলো-বাতাস, ধুলো-বালি এবং জীবানু ও পোকামাকড় থেকে আমকে রক্ষা করে।
তবে বাংলাদেশের আমের জন্য যে ব্যাগ ব্যবহার করা হয় তার ভিতরে কার্বন কাগজ দেওয়া থাকে। ফলে আম কোনো আলো পায় না। এই আমে ক্লোরোফিল কমে যায় এবং হলুদ রং ধারণ করে।
এবছর প্রায় ৩২ লাখ ব্যাগ বিক্রি হয়েছে যার প্রতিটির দাম কমপক্ষে ৪ টাকা। এই ব্যাগগুলো মূলত চাপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নঁওগা, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরে বিক্রি হয়েছে।
ব্যাগ বিক্রির জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কোনো নির্দেশনা না থাকায় অনেক কৃষি কর্মকর্তা তা কৃষককে সুপারিশ করেন নাই। তবে আম গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সরফ উদ্দিনের নেতৃত্বে স্থানীয় একটি কৃষিভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিপণন কর্মকর্তারা চীনা কোম্পানির ব্যাগ বিক্রি করেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে ব্যাগিং প্রযুক্তির আমে কোনো স্বাদ নেই বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাটের আম চাষি মাইনুল ইসলামের দাবি, এই আমের কোনো স্বাদ নাই। ভোলাহাটের আরেক আম চাষিও একই দাবি করেন। তিনি বলেন, দেখতে পাকা মনে হলেও ভিতরে পাকে না। আবার বেশি পাকলে তিতা লাগে।
এবিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা পরিষদের পুষ্টি বিভাগের পরিচালক ড. মনিরুল ইসলাম জানান, ক্লোরোফিলের মাধ্যমে আম আলো থেকে খাবার সংগ্রহ করে। কিন্তু ব্যাগিং করা আমে কোনো আলো ঢুকতে পারে না, তাই আমের স্বাদে ভিন্নতা আসতে পারে।
তিনি বলেন, এজন্য আমের অর্গানোলেপটিক নিরীক্ষা দরকার ছিল। এই বিজ্ঞানী দাবি করেন, কার্বন কাগজ দিয়ে আমকে মোড়ানো হচ্ছে তা কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটি আমের সংস্পর্শে এসে কোনো আয়নিক বন্ধন করে কীনা তা নিয়েও পরীক্ষা করা দরকার।
পুষ্টি বিজ্ঞানী মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যাগিং করা সব আমের রং একই রকম হওয়ায় আম দেখে কেউ চিনতেই পারে না, কোনটা কোন জাতের আম। এছাড়া, কার্বাইড দিয়ে পাকানো আমের রং আর ব্যাগিংয়ের আমের রং একই হওয়ায় ভোক্তারা প্রতারণার শিকার হতে পারেন।
তবে যে দাবিতে ব্যাগিং প্রযুক্তির যাত্রা শুরু তা নিয়েও ধোকার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন এই বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, ছোট গাছের সব আমে ব্যাগিং হয়ত করা সম্ভব। কিন্তু বড় গাছের মগডালের আম ব্যাগিং করা অসম্ভব্। তাই মগডালের আমকে রোগমুক্ত রাখতে কৃষকরা নিয়মিত কীটনাশক বা বালাইনাশক ব্যবহার করছেন। আমি নিজেই তা চাপাইনবাবগঞ্জে দেখে এসেছি।
তাই বিষমুক্ত আম চাষের যে প্রপাগান্ডা শুরু হয়েছে তাতে ভোক্তা ও চাষিদের পা না দেওয়ার দাবিও তার।
কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একটি ব্যাগের দাম ৪ টাকা আর তা লাগাতে খরচ হয় আমপ্রতি ৫০ পয়সা। এই হিসাবে এক কেজি আমে বাড়তি খরচ কমপক্ষে ২৫ টাকা।
ভোলাহাট আম ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক চুটু বলেন, রফতানির আশা দিয়ে এই ব্যাগিং জনপ্রিয় করার চেষ্টা হলেও সবাই তা করতে পারছে না। এছাড়া খরচ বেশি হবার কারণে গ্রহণযোগ্য হবে না ব্যাগিং। তার দাবি কৃষকরা ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি প্রত্যাখান করবে।
চীন থেকে বাংলাদেশে এনে ব্যাগিং প্রযুক্তির প্রচলনকারী সরফ উদ্দিন দাবি করেন, বিদেশে যেন আম রফতানি হয় সেজন্য এই প্রযুক্তিটি নিয়ে এসেছেন তিনি।
তবে গবেষণা ছাড়াই কেন এই প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু করলেন তার কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি। তবে তার দাবি, ব্যবহারের আগে অর্গানোলেপটিক টেষ্ট করা হয়েছে।তিনি স্বীকার করেন, কার্বন কাগজের কোনো পরীক্ষা করা হয়নি।
সরফ উদ্দিন দাবি করেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই কাগজ নিরীক্ষা করার সক্ষমতা নেই। এই কার্বন কাগজে কোন্ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, তাই তা গবেষণা করা হয়নি। তবে অন্যরা চাইলে এটা নিয়ে গবেষণা করতে পারে।
Comments
- No comments found
Leave your comments