আমের বিশেষ হিমাগার
আমের মৌসুম বাড়ছে আরও এক মাস কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করে আম পাকা প্রায় এক মাস বিলম্বিত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী আম পাকা শুরু হলে আর ধরে রাখা যায় না। তখন বাজারে আমের সরবরাহ বেড়ে যায়। যেকোনো দামেই বেচে দিতে হয়। তাতে কোনো কোনো বছর চাষির উৎপাদন খরচই ওঠে না। অথচ ব্যবসায়ীদের ধারণা, আর ২০ দিন ঘরে রাখতে পারলেই ওই আম দ্বিগুণ দামে বেচা যায়। এবার চাষির সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করে আম পাকা প্রায় এক মাস বিলম্বিত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেসের (আইবিএসসি) পরিচালক এম মনজুর হোসেন। রাজশাহী মহানগরের নামোভদ্রা এলাকায় ‘আকাফুজি অ্যাগ্রোটেকনোলজি’ গবেষণা খামারে আম সংরক্ষণের এই ‘বিশেষায়িত হিমাগার’ নির্মাণ করা হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সাড়ে ১১ ফুট এবং উচ্চতা সাড়ে ৯ ফুট। তিন টন ধারণক্ষমতার এই হিমাগার প্রস্তুত করতে ব্যয় হয়েছে তিন লাখ টাকা। ১ মাস ৪ দিন আগে আম রাখা হয়েছিল হিমাগারে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ আগস্ট) হিমাগার থেকে আম বের করে পরীক্ষা করে দেখা হলো। ল্যাংড়া, বারি-ফোর ও সুরমা ফজলি জাতের আম অবিকল রয়েছে। এ ছাড়া ১ মাস ২০ দিন আগে রাখা লকনা ও আম্রপালিও রয়েছে। হিমাগার থেকে বের করা আম কেটে উপস্থিত লোকজনকে খাওয়ানো হয়। উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেন বলেন, ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল, ২০ থেকে ২৫ দিন আম পাকা বিলম্বিত করা যায় কি না। তাঁর গবেষণায় দেখা গেছে, বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে সেটা করা সম্ভব। তিনি বলেন, আমের ভেতর থেকে যে হরমোন নিঃসরণের কারণে আম পেকে যায়, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আবার আম যাতে পচে না যায়, সে জন্য হিমাগারের ভেতরে বিশেষ পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এম মনজুর হোসেন বলেন, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, কেনিয়া, মেক্সিকোতে আম পাকা বিলম্বিত করার প্রযুক্তি আরও আগেই বেরিয়েছে। কিন্তু তিনি করেছেন একটা ব্যয়সাশ্রয়ী সহজ প্রযুক্তির মাধ্যমে। এই হিমাগারে প্রতিদিন গড়ে ১০ ইউনিট বিদ্যুৎ খরচ হয়। বিদ্যুৎ ও শ্রমিক খরচ যোগ করলে এক কেজি আম বাজার থেকে কিনে এই হিমাগারে এক মাস সংক্ষরণ করতে মাত্র পাঁচ টাকা খরচ পড়বে। তিন টন আম রাখতে খরচ হবে ১৫ হাজার টাকা। আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের নির্বাহী সহসভাপতি মুহাম্মদ নাদিম বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমের (সিএসআর) আওতায় এই গবেষণাকাজে তাঁরা অর্থায়ন করেছেন। প্রকল্প সফল হলে তাঁরা তাঁদের হিমাগার প্রস্তুতের জন্য অর্থায়ন করবেন। তা ছাড়া উদ্ভাবক এম মনজুর হোসেনের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তাতে সমানভাবে ব্যাংকও এই গবেষণাকাজের মেধাস্বত্বের মালিক হবে। এই পদ্ধতিতে আম পাকা বিলম্বিত করতে হলে আধুনিক ঠুসি ব্যবহার করে বোঁটার একটু ওপর থেকে আম কেটে গাছ থেকে পাড়তে হয়। এরপর ইথিলিন জৈব সংশ্লেষণ প্রতিরোধক দ্রব্য দিয়ে সৃষ্ট পরিবেশে ২৪ ঘণ্টা আম রেখে দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া হরমোন নিঃসরণ বন্ধে সহায়তা করে। এই পর্ব শেষে আম হিমাগারে রেখে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আম সংরক্ষণের উপায় আগেই উদ্ভাবন করা হয়েছে। আমরাই দেরিতে করলাম।’ হিমাগারের ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতের আম বিভিন্ন কার্টনে রাখা। কোন আম কোন তারিখে সংগ্রহ করা হয়েছে, তার তারিখ কার্টনের গায়ে লেখা রয়েছে। দেখা গেল, হিমাগারে সবচেয়ে ভালো রয়েছে বারি-ফোর ও সুরমা ফজলি আম। এগুলো এক মাস চার দিন আগে রাখা হয়েছিল। হেরিটেজ-রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা ও আম গ্রন্থের লেখক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের মে থেকে আগস্ট—এই চার মাস আমের মৌসুম। তবে আগস্টে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ফজলি পাওয়া যায়। তারপর শুধু আশ্বিনা থাকে। নতুন এই হিমাগার আমের মৌসুমকে আরও এক মাস বাড়িয়ে দেবে। এই হিমাগারের সুবিধা নিতে পারলে চাষিকে আর আম পাকা নিয়ে চিন্তায় পড়তে হবে না।
Comments
- No comments found
Leave your comments