আম নিয়ে ভাবার সময় এসেছে
ল্যাংড়া, গোপালভোগ, খিসসাপাত, লক্ষণ ভোগ, হিমসাগর, ফজলি, আশ্বিনা শত শত নামের শত শত জাতের একটি ফল, আম। পৃথিবীতে কোন ফলের স্বাদের এত ভিন্নতা নেই-যা আমের আছে। শুধু তাই নয়, এত সুস্বাদু ফলও পৃথিবীতে নেই। এ জন্যই হয়তো আমকে ফলের রাজা বলা হয়। চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৩২ থেকে ৬৪৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যে কোন এক সময় এ অঞ্চলে ভ্রমণে বাংলাদেশের আমকে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করেন।
আম অর্থ সাধারণ। প্রচুর খাদ্যপ্রাণ সমৃদ্ধ সাধারণের ফল আম। খৃষ্ঠপূর্বকাল থেকে এ জনপদে আম প্রিয় বাঙালির সন্ধান মেলে। রামায়ন ও মহাভারতে আম্রকানন শব্দের দেখা মেলে। ফল হিসেবে এ অঞ্চলে আমের ইতিহাস সাড়ে ছয় হাজার বছরের পুরনো। সম্রাট বাবর আমকে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট ফল হিসেবে উল্লেখ করেন। সুপ্রাচীনকালের সেই আম আজ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির বিরাট একটা জায়গা দখল করেছে ইতোমধ্যে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় আম উৎপাদন পুরোটাই বাণিজ্যিক। দেশের সব জেলাতে কম-বেশী আম উৎপাদিত হলেও রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা আম উৎপাদন অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। চাপাইনবাবগঞ্জের সদর, শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, রাজশাহীর বাঘা, চারঘাট উপজেলার অধিকাংশ মানুসের অর্থনীতির নিয়ামক আম। এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ পরিবারের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে শুধু আম চাষের উপর। সারাদেশে এবার আমের উৎপাদন ৪ লাখ মেঃ টনের ওপরে। এর মধ্যে শুধু চাপাইনবাবগঞ্জেই উৎপাদিত হয়েছে সোয়া দুই লাখ মেঃ টন।
চাপাইনবাবগঞ্জে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতে আম গাছের পরিমাণ ১৮ লাখ। আর রাজশাহী জেলায় ৮ হাজার ৪শত হেক্টর জমিতে আম উৎপাদিত হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার মেঃ টন। দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার হচ্ছে চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাট। কানসাট আম আড়তদার সমিতি সূত্রে জানা যায়, কানসাটে প্রতিদিন ৬ কোটি টাকার আম কেনাবেচা হচ্ছে। বেচাকেনার পরিমাণ ইতোমধ্যে ২ হজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এ অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ্য মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে আম উৎপাদন এবং বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে।
এ বছর ঢাকাসহ সারাদেশে আমের দাম অনেকটা সস্তা। অন্তত পক্ষে অন্যান্য পণ্যের দাম যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে সে অবস্থায় আমের দাম বাড়েনি। অধিকন্তু চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এখনো বিপুল পরিমাণ আম অবিক্রিত। কিন্তু দেশের বৃহত্তর একটা অঞ্চলের অর্থনীতি অনেকটাই আমের উপর নির্ভরশীল। তারপরও রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর জেরার হাজার হাজার হেক্টর ফসলি জমি আম চাষের আওতায় চলে যাচ্ছে। এতে করে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের কৃষক আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ আমের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের তথা জাতীয় অর্থনীতির গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য আম নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। আম চাষ এবং ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে আম সংরক্ষণ, আম নির্ভরশীল শিল্প-কারখানা নির্মাণ এবং বিদেশে রপ্তানির সুযোগ সৃষ্টির দাবি উঠেছে।
চাপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের মতো ভারত ও পাকিস্তানেও বিপুল পরিমাণ আম উৎপাদিত হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ভারত ৪১ হাজার মেঃ টন এবং পাকিস্তান ৪৭ হাজার মেঃ টন আম রপ্তানি করে থাকে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ আম উৎপাদিত হয় তাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। কিন্তু আমাদের দেশে রপ্তানিকারকদের এগিয়ে না আসা, বিমান সমস্যা প্রভৃতি কারণে আম রপ্তানি সম্ভব হচ্ছে না। আম পচনশীল ফল হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সংরক্ষণ সম্ভব হয় না। এজন্য আম প্তানিতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা জুস তৈরি করে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা যায়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রাণ গ্রুপ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। ২০০১ সালে প্রাণ গ্রুপ নাটোরে আমের পাল্প তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে। যে পাল্প থেকে তৈরি হয় জুস। যা বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের আম চাষিদের ব্যাপক উপকারে আসছে। এবছর প্রাণ কোম্পানি রাজশাহী, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৪০ হাজার মেঃ টন আম ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। যা গত বছর ছিল ৩০ হাজার মেঃ টন। নাটোরে প্রাণ গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (অপারেশন)-এর সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা নিজেদের ক্রয়কৃত আম এবং পাল্প সংরক্ষণের জন্য ৪০ হাজার মেঃ টন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন সংরক্ষণাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। কথা হচ্ছে প্রাণের ৪০ হাজার মেঃ টন নয় প্রয়োজন দুই লাখ মেঃ টন আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। ব্যাপক ভিত্তিক আম সংরক্ষনাগার নির্মাণ করতে পারলে বছরের সব সময় আম পাওয়া যাবে। আবার আম চাষিরা নিজেরাও আলুর মতো আম সংরক্ষণাগারে রাখতে পারবে। ক্ষেত্রে আমের প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সংরক্ষণাগার নির্মাণের জন্য পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আম প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রাণের মতো অন্যান্য কোম্পানিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আমের ক্ষেত্রে আরো একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে গবেষণা। কারণ আমের উৎপাদন ক্ষেত্রে অফ ইয়ার অন ইয়ার বড় ফ্যাক্টর। গবেষণার মাধ্যমে আম্রপলির মতো নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে, যাতে করে একই গাছে প্রতিবছর আম পাওয়া যায়।
যেহেতু দেশের বৃহৎ একটা অঞ্চলের অর্থনীতি আম নির্ভর হয়ে পড়েছে। আম উৎপাদন স¤পূর্ণ বাণিজ্যিক রূপ লাভ করেছে এবং জাতীয় অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলছে। তাই উন্নত জাত উদ্ভাবন, উৎপাদন, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং রপ্তানিতে সরকারি বেসরকারি সকল প্রকার উদ্যোক্তাকে এগিয়ে আসতে হবে। এতে করে বাড়বে স্বনির্ভর লোকের সংখ্যা, বাড়বে কর্মক্ষেত্র, উপকৃত হবে জাতীয় অর্থনীতি।
লেখক,সহকারী পরিচালক,পিআইডি,তথ্য মন্ত্রণালয়
Comments
- No comments found
Leave your comments